বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০১৪

সপ্তাহের সেরা পছন্দ



ফেরা

- হাসান ইমতি

প্রায় এক যুগ পর অবশেষে সত্যিই আবার ফিরে এলাম,
এই খানে ঝুপড়িমত চা সিগারাটের একটি দোকান ছিল,
এক বুড়ো চা ওয়ালা আর তার ঝগড়াটে দুই বউ ছিল,
একটি বউ আবার কড়কড়ে যুবতী ছিল, তার হাতের কড়া
লেবু চা ছিল তার চেয়েও, তার অহেতুক বাধভাঙা হাসির,
তার দুধেল খুনসুটির চেয়েও তরতাজা উত্তেজক,  
দোকানময় তাই তখন অনেক খদ্দেরের ভিড়ও ছিল,
এখানে কেটেছিল অনেক বন্ধুময় লেবুগন্ধি বিকেল,
এখানে সময় থমকে যেত গন্তব্যহীন মানুষের মত

রমিজ বুড়োর চায়ের দোকানের কথা জানতে চাইলে
আজ আর কেউ বলতে পারলো না, চিনলও না কেউ,
স্মৃতিময় পুরনো শহরতলিতে মনে হয় এত দিন পর ফিরে
আসা একটি কষ্টকর ভুল, এভাবে হয়তো কখনো ফিরতে
হয় না ফেলে আসা মৃত স্মৃতির কাছে, সামনে এগিয়ে
মৃন্ময়ের সেলুনের খোঁজ নিলাম, যদি জানা যায় কিছু,
সে তো আর কাঁচা ঝুপড়ি দোকান নয়, রীতিমত কংক্রিট
আর চুন সুরকির পাকা দালান বাড়ি, তাই চিনল কেউ কেউ,
ইন্ডিয়া চলে গেছে যুদ্ধের বছর, এর বেশী কিছু জানা গেল না,
মৃন্ময়ের নাদুস নুদুস ফর্সা বউ গণ্ডাকয় ছেলে পুলেও ছিল,
তাদের নাম নিশানাও আরও অনেকের মত হারিয়ে গেছে
এই শহরতলীর পরিবর্তনশীল আলো ঝলমলে দিনপঞ্জি থেকে   

জানা গেলো না গলির মোড়ের বুড়ো হরিহর ময়রার মিষ্টির
দোকান, নন্দীলাল পণ্ডিতের পুথিঘর লাইবেরি, কিম্বা মিহিরের
ছাপাখানার কোন হদিসও, কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এইসব
অপ্রয়োজনীয় মানুষদের এই শহরের কেউ আজ আর চেনে না,
এরা আজ আর বদলে যাওয়া শহরের হাঁসি কান্নার অংশ নয়

খুজতে খুজতে অবশেষে ফিরে এলাম পুরনো সেই প্রিয় ঠিকানায়,
সেই চুন সুরকির পুরনো দালান ঘর, সবুজ ঘাসময় উঠোন বাড়ি,
বাড়ীর সামনে ক্রিকেট খেলার খোলা মাঠ, প্রতি বিকেলে ব্যাট
বলের খেলা, খেলার আড়ালে খেলা, চোখে চোখে খেলা, কথার
খেলা, অপেক্ষার খেলা, এখানে কেটেছে অনেক স্মৃতিময় সময়,
কিন্তু কিছুই আজ আর নেই আগের মত, বদলে গিয়েছে বিস্তর,  
বদলে গিয়েছে মানুষ, বদলে গিয়েছে সময়, বদলে গিয়েছে সব,
এক যুগ পর ফিরে আমিই কেবল রয়েছি পুরনো ঘড়িতে স্থির

ডেভলপারের অশেষ বদান্যতায় সেখানে আজ জ্বলজ্বল চোখে
ধরণীর নরম বুক কংক্রিটের কঠিন পায়ে মাড়িয়ে নির্ভুল দাড়িয়ে
আছে বারতলা মাল্টিপ্লেক্স, বুকেবসুমতি বিল্ডার্সনামের
অত্যুজ্জ্বল সাইন বোর্ড ঝুলে আছে উন্নতির রাজসাক্ষী হয়ে,
খোঁজ নিজে জানলাম, বার তলায় সর্বমোট চব্বিশটি ফ্ল্যাট,
নাগরিক ইট সুরকির আকাশহীন লালচুলো আধুনিক বস্তি,
এরই কোন একটির টানেই বহুদিন পর হয়তো আমি ফিরেছি,
ডাক নাম তার ছিল রিমঝিম, এই নামে তাকে কেউ আজ
আর চিনল না, সামাজিক নিয়মে সল্প পরিচিতা, রক্ষণশীল সে
সময়ে তার পুরো নামটিও জানা হয়নি কখনো, তার চোখের
তারায় কেবলই ছিল সাগরের নীল আহবান, তার অদেখা
প্রবাসী বাবার নাম ফয়েজ বা সরফরাজ গোছের কিছু ছিল,
বংশ পদবীও আজ ঠিক মনে নেই, সে অনেকদিন আগের কথা,  
কে আমি, কেন এসেছি, কোথায় এসেছি, কার কাছে এসেছি
এইসব নানাবিধ সঙ্গত সামাজিক প্রশ্নের কোন সদুত্তর নেই আজ,
ফিরে যাবার ছাড়পত্র হাতে আসা আমার বশেও নেই অনন্ত সময়,
তাই আজ খোঁজ মিলল না ফেলে আসা কিছু প্রিয় অতীত ভুলের,
একই পৃথিবী, একই আকাশ, তবু কোন কিছুই আজ   এক  নয়,
বদলে গিয়েছে সময়, বদলে গিয়েছে মানুষ, বদলেছে ঠিকানা,  
এই পৃথিবীতে থেকেও সেই স্মৃতিময় মানুষগুলো আজ   আর  নেই




ও কিছু না

- দেবাশিস লাহা

"
আয় তোকে আদর করি "
এই বলে মেয়েটার পিছু নিল এক হাজার দাঁত আর নখ !

ছূট ! ছুট! ছূট !
ছূটতে ছুটতে মাটি চিরে ফেললো মেয়েটার পা
বললো -- আমায় ফিরিয়ে নাও !
মাটি বললো না !
মেঘ ছুঁয়ে ফেললো ওড়না!
বললো -- "আমায় উড়িয়ে দাও "
মেঘ বললো না !
সূর্য ছুঁয়ে ফেলল চোখ
বললো "আমায় পুড়িয়ে দাও "
সূর্য বললো না !
বাতাস জড়িয়ে ধরলো ঠোঁট
বললো "আমায় কুড়িয়ে নাও "
বাতাস বললো না !

তবু ছুটতে থাকল মেয়েটা
ঘাসের উপর ছিটকে পড়ল স্কুল ব্যাগ!
সকাল ফুরিয়ে দুপুর , দুপুর ফুরিয়ে বিকেল !
তবু পিছু ছাড়ল না থাবা !
শিশিরের মতো মিলিয়ে গেল দূরত্ব,
এক দিন মেয়েটাকে ধরেই ফেললো ওরা

তারপর শুধু মট মট শব্দ !
এত কিছু ভাঙা যায় কে জানতো !
প্রথমে চুড়ি,
তারপর আঙুল আর হাত ,
তারপর পা !
সব কিছু ভাঙতে ভাঙতে আরও
এগিয়ে এলো ওদের থাবা,
ঝনঝনিয়ে ভেঙে গেলো পুতুল বাড়ি,
টেডি বিয়ার,
সদ্য ফোটা গোলাপ,
তারপর আরও কত কি!

বাবার মুখ, ছোট্ট ভাই বিনুর চোখ ,
মামা বাড়ির নদী, পাশের বাড়ির ছাদ ,
এমন কি ইস্কুলের জানালা দিয়ে দেখা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি !
তাও ভেঙে ফেলল ওরা !

ঠিক তখনই নেমে এলো অন্ধকার,
এক বুক জোনাকি নিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে

"
তোর নাম কি রে ? " ফিসফিসিয়ে জানতে চাইল মেয়েটা,

"
কেন , চিনলি না আমায়? আমি যে তোর নীল পরী "

"
ওহ, তাই বুঝি এত দেরি করে এলে ? "

টুপ করে একটা শব্দ,
ও কিছু না !
ঘাসের উপর গড়িয়ে পড়লো আরেক ফোঁটা রক্ত .




লাসভেগাসের প্লেন

- অব্যয় অনিন্দ্য

প্লেনে উঠার সময় পাইলট কথা দিয়েছিল -
আলোর গতিকে হারিয়ে চোখের পলকে
আমাকে লাসভেগাসে পৌঁছে দিবে।
অথচ চোখ খুলে দেখি পাঁচ বছরের ছোট্ট আমি কাগজের
প্লেনে পায়রার সাথে পাল্লা দিচ্ছি রায়পুর গ্রামের চাতালে;
পাশে দাদু দুহাতে আমার শৈশব নিয়ে সাপলুডু খেলছে,
খেলতে খেলতে সমস্ত শৈশব চলে গেল তার চোখে,
কিছু বোঝার আগেই সেই চোখ বুজে গেল জন্মের মত।

প্লেনটা আর একটু ঝাঁকুনি দিতেই দেখি -
জীয়ন পুকুরের উত্তরমাঠে রাবার ঢিলা হাফ-প্যান্টটাকে
শরমদণ্ডের পোয়াইঞ্চি উপরে টেনে টেনে তুলছি বার বছরের আমি;
আর একটা পোয়াতি বউ-কথা-কওর ডানায় উড়ে যাচ্ছে
আমারর কিশোরবেলার প্রতিটি ঘুমহীন দুপুর ।
পাশের কুট্টি খালে উদোম গায়ে নাইতে নেমেছে আমার ছোট্ট প্রেমিকা,
জলে ধুয়ে যাচ্ছে প্রেমিকার শৈশব
যৌবনে সে কোথায় ডলারের আলোয় গা ধুইছে সেটা খুঁজতেই
মেরিলিন মনরোর মৃত্যুদৃশ্য ভেসে উঠল।

হঠাৎ শুনছি পাইলট সুন্দরী বিমানবালাকে বলছে,
ওকে নামিয়েই দাও।
ওর প্লেন কখনো লাসভেগাসে যাবে না।




অপেক্ষা

-শিল্পী রহমান

হঠাৎ কইরা বুকের মধ্যে কামুড় মাইরা উঠে সেইসব কথা
সত্যই কি আর মনে পড়ে না আমারে ?
ব্যাবাগ ভুইলা গেলি?
রাইতের পর রাইত
দিনের পর দিন
সংসার করসিলাম দুইজন এক লগে।
ক্যামনে পারস ?
একবারও মনে পড়ে না?
আমারে শিখাইয়া দে না।
আমিও তো চাই ভুলতে তরে ।
সেই যে তোর লাইগা খোঁপায় পড়লাম ফুল
শাড়ি পইড়া কপালে দিলাম একখান লাল টিপ।
আমারে দেইখা তুই কেমন নাচন দিয়া গাইছিলি
কেন পিরীতি বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি-
আমি আর যাইতে পারলাম কই?
সেই যাওয়া তো গেলি তুই।
রাইত যতই বাড়ে
বুকের মধ্যে বিষ কাঁকড়ার লাহান কামড়াইয়া ধরে সেইসব কথা।
সকালের আলো ফুটা পর্যন্ত বইসা থাকি
নিজেরে বুঝ দেই আজর নাই বইলা।
কিন্তু ওই আসমান সাক্ষী,
ওই চাঁদ সাক্ষী,
এই বাতাস সাক্ষী,
আম জাইগা থাকি তোর লাইগ্যা ।
যদি আচমকা আইসা পরস কোন এক রাইতে ,
যদি আমারে ঘুমে দেইখা ফেরত যাস চইলা ।
পারুম না সইতে সেই জ্বালা আমি।
এই অবুঝ পরান জাইগা থাকে সেই আশায় ।
ঘুম আহে না দুই চক্ষ্যে আমার
ঘুম আহে না রে -
বুকের মধ্যে বিষ কাঁকড়ার লাহান কামড়াইয়া ধরে সেইসব কথা।
সত্যই মনে পড়ে না আর আমারে?
একবারও না?




শপিং মলে দুপুরের রোদ্দুরে

- ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

এলাকার সর্ব বৃহৎ শপিং মল ছুঁয়ে নেমে এসেছে দুপুরের রোদ্দুর,
আমার কবিতা ধ্রুপদী নয় নয় পদিপিসির বর্মীবাক্স,
বরিশাল এলাকার যত নদী মাদারিপুরের যত ধানক্ষেত আমাকে ছুঁতে পারেনি,
আমি মিসিসিপি ওহায়োর ধারে বসেও সে দুঃখ ভুলিনি।

কি লিখব?
আমার জীবনের সংগ্রাম কিছু নেই,
মুক্ত তালুর ওপর সাজানো জীবন প্রতীক্ষিত
সে মানুষ কি লিখতে পারে?

কোনদিন না ছোঁয়া ধানক্ষেতেরা
তার জন্য অপেক্ষা করে শেষে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে,
নদী হাহুতাশ করে,
একটা ভূমিহীন কৃষকেরও যে আশ্রয় থাকে,
আমার স্বাধীনতা সাতচল্লিশ
শপিং মল আর মাল্টিস্টোরেড তা কেড়ে নেয় তীব্র উল্লাসে।



নাগরিক

- নীরব দেবশর্মা

ঝুল বারান্দায় ঝুলতে থাকা অন্তর্বাস থেকে
বাসি যৌনতার গন্ধ শুকছে উদাসী রোদ্দুর...
ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে নিঃসঙ্গ রাত্রিকে পোড়াচ্ছে
ত্রিফলা নিয়ন আলো...
সপ্তাহ অন্তর চ্যানেলে চ্যানেলে মেগা সিরিয়ালের ভিড়ে
কামদুনি গাইঘাটার পুনঃসম্প্রচার...
প্রতিবাদী মিছিলে চুপচাপ গলে যাচ্ছে
নির্লিপ্ত সাদা কিংবা রঙিন মোম ...
ওদিকে গামছা পরা সংবিধান হেসে চলেছে
সফল প্রচেষ্টার সাক্ষী হতে...
পার্কে-মাঠে গড়াগড়ি খাচ্ছে খাম খোলা প্রেম
মাঝরাতে সস্তার ট্যারিফে তরঙ্গে তরঙ্গে
মিলিত হচ্ছে শুক্রাণু ডিম্বাণু...
ব্যস্ত রাস্তায় ধীরপায়ী শুধু
সংক্ষিপ্ত পরিচয়ধারী পাগল আর বেকার...
শিল্পী-সাহিত্যিক-সুশীল সমাজে বারোয়ারী দলাদলি
চমক বলতে শুধু সততার বিজ্ঞাপনে নেতা-নেত্রীর সদাহাস্য মুখ...
এসব দেখতে দেখতেই যে নাগরিক হয়ে উঠছি
জানান দিচ্ছে পুণ্যবাহী গঙ্গা...



আমার কেবলই ভুল হয়ে যায়

-
রাহাগীর মনসুর

আমার কেবলি ভুল হয়ে যায়
বেনসনের দাম মেটাতে পারে না
শূন্য মানিব্যাগ
পথচারীর বেশে
যখন পথে ফিরি
ভুল হয়ে যায়
জেব্রা-ক্রসিঙ এ ......

কবেকার সেই পুরন চাঁদ
কথার পিঠে কথা
ভুল হয়ে যায় .......

সকালের নাস্তা
সাতেটার বিরক্তিকর সাইরেন
ভুল বিছানা.....
সকালের নিউজ পেপার
দু-চারটে খুন,নিহতদের লাশ
শোকে মহুমান শবযাত্রায়
ভুল হয়ে যায় .....

বিদুৎ এর বিল
উলট হাত ঘড়ি
ভুল হয়ে যায় .....

মনে থেকে যায় শুধু
তোমার ব্যালকনিতে দুলতে থাকা......মানিপ্ল্যানট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন